ডেস্ক রিপোর্ট: টানা ২৪ বছর ধরে সিরিয়ার ক্ষমতায় থাকা বাশার আল–আসাদের শাসনামল শেষ হয়েছে এক নাটকীয় পরিণতিতে। বিদ্রোহী যোদ্ধারা যখন রাজধানী দামেস্ক দখলের দ্বারপ্রান্তে, তখন গত রোববার সিরিয়া ছেড়ে পালিয়ে রাশিয়ায় রাজনৈতিক আশ্রয় নেন দেশটির ক্ষমতাচ্যুত এই স্বৈরশাসক।
বার্তা সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়, আসাদের পলায়নের খবর তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী, সরকারি কর্মকর্তা এমনকি পরিবারের সদস্যদের কাছেও ছিল সম্পূর্ণ অজানা। রয়টার্সের এক বিশেষ প্রতিবেদনে জানা গেছে, এ বিষয়ে অবগত এক ডজনেরও বেশি ব্যক্তি জানিয়েছেন, আসাদ তার পরিকল্পনার বিষয়ে কাউকে কোনো সংকেত দেননি।
সিরিয়া ছাড়ার ঠিক আগের দিনও আসাদ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে অংশ নেন। ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন প্রায় ৩০ জন সেনা ও নিরাপত্তা কর্মকর্তা। বৈঠকে আসাদ সবাইকে আশ্বস্ত করেন যে রুশ বাহিনী শিগগিরই তাদের সহায়তায় এগিয়ে আসবে। বৈঠকে উপস্থিত একজন কমান্ডার, নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, আসাদ দৃঢ়ভাবে সবার সামনে নিজ অবস্থানে অনড় থাকার বার্তা দিয়েছিলেন।
কিন্তু বৈঠক শেষ হওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই যে তিনি সিরিয়া ছেড়ে পালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তা কারও কল্পনাতেও ছিল না। একই অবস্থা ছিল বেসামরিক কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রেও। কেউই ভাবতে পারেননি, শাসনামলের এমন এক সংকট মুহূর্তে আসাদ নিজ দেশ ত্যাগ করবেন।
সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল–আসাদ দপ্তরে প্রাত্যহিক কাজ সেরে কর্মকর্তাদের জানান, তিনি বাসায় ফিরবেন। তবে বাসায় না গিয়ে সরাসরি বিমানবন্দরে চলে যান বলে তার এক ঘনিষ্ঠ সহযোগী জানিয়েছেন।
আসাদের গণমাধ্যম উপদেষ্টা বুথাইনা শাবানও এই ঘটনায় বিভ্রান্ত হন। দেশ ছাড়ার আগে আসাদ তাকে নিজের বাড়িতে ডেকে একটি ভাষণ লেখার কথা বলেন। তবে বুথাইনা যখন তার বাড়িতে পৌঁছান, তখন বাড়ি একেবারে খালি ছিল।
আরব রিফর্ম ইনিশিয়েটিভের নির্বাহী পরিচালক নাদিম হউরি বলেন, “আসাদ শেষ পর্যন্ত নিজের অবস্থান ধরে রাখতে ব্যর্থ হন। তিনি সেনাদের একত্রিত করতে পারেননি এবং সমর্থকদের ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দিয়ে নিজেই পালিয়ে যান।”
মস্কোয় রাজনৈতিক আশ্রয়ে থাকা সিরিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট বাশার আল–আসাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেনি রয়টার্স। তবে তার দেশত্যাগের আগে এবং পরের ঘটনাগুলো জানার জন্য অন্তত ১৪ জন ঘনিষ্ঠ সহযোগীর সঙ্গে কথা বলা হয়েছে। তাদের কেউই নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি, তবে সিরিয়া ছাড়ার আগমুহূর্তের নানা ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন।
তিনটি ভিন্ন সূত্র জানিয়েছে, ক্ষমতা ছেড়ে পালানোর পরিকল্পনার কথা আসাদ তার ছোট ভাই মাহেরকেও জানাননি। মাহের সিরিয়ার সেনাবাহিনীর অভিজাত চতুর্থ সশস্ত্র ডিভিশনের কমান্ডার ছিলেন। দামেস্ক পতনের পর মাহের একটি হেলিকপ্টারে চড়ে ইরাক চলে যান এবং সেখান থেকে রাশিয়ায় পৌঁছান।
সিরিয়ার ঘনিষ্ঠ মিত্র লেবাননের নিরাপত্তা কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আসাদ তার দুই মামাতো ভাই এহাব এবং ইয়াদ মাখলৌফকে বিদ্রোহীদের সম্মুখীন করে দামেস্কে রেখে যান। পরে তারা একটি ব্যক্তিগত গাড়িতে লেবাননের সীমান্তে পালানোর চেষ্টা করেন। তবে বিদ্রোহীদের গুলিতে এহাব নিহত হন এবং ইয়াদ আহত হন।
এই ঘটনায় কোনো পক্ষই আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দেয়নি, এবং রয়টার্সও এ তথ্য যাচাই করতে পারেনি।
গত রোববার ভোরে বিদ্রোহীদের রাজধানী দামেস্কে প্রবেশের মুখে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল–আসাদ গোপনে একটি উড়োজাহাজে দেশ ত্যাগ করেন। তার উড়োজাহাজ এমনভাবে পরিচালিত হয়েছিল যে, সেটি রাডারে শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি।
এই পলায়নের মধ্য দিয়ে আসাদ পরিবারের টানা ৫৩ বছরের শাসনের ইতি ঘটে। ১৯৭১ সালে বাশারের বাবা হাফিজ আল–আসাদ সিরিয়ার ক্ষমতা গ্রহণ করেন এবং পরবর্তী ২৯ বছর দেশ শাসন করেন। তার মৃত্যুর পর ২০০০ সালে ক্ষমতায় আসেন বাশার আল–আসাদ। তার ২৪ বছরের শাসনের শেষ ১৩ বছর ছিল গৃহযুদ্ধ ও সংঘাতে বিধ্বস্ত।
সূত্র জানিয়েছে, দামেস্ক ত্যাগের পর বাশার আল–আসাদ প্রথমে সিরিয়ার উপকূলীয় শহর লাতাকিয়ার রাশিয়ার হেমেইমিম বিমানঘাঁটিতে যান। সেখান থেকে তাকে মস্কোয় উড়িয়ে নেওয়া হয়। মস্কোয় তার স্ত্রী আসমা আসাদ এবং তিন সন্তান আগে থেকেই অপেক্ষা করছিলেন।
সিরিয়া থেকে বাশার আল–আসাদকে নিরাপদে সরিয়ে নিতে রাশিয়া কূটনৈতিকভাবে তৎপর ছিল। রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ দোহায় কাতার ফোরামে অংশ নিয়ে আসাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আলোচনা চালান। তুরস্ক ও কাতার বিদ্রোহীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তার নিরাপদ প্রস্থান নিয়ে কথা বলে।
পশ্চিমা সূত্র জানায়, আসাদের উড়োজাহাজ হামলা থেকে রক্ষা করতে রাশিয়া প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করে। এই উদ্যোগে আসাদকে নিরাপদে মস্কোয় সরিয়ে নেওয়া হয়।
কাতারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি, আর রয়টার্স এইচটিএসের প্রতিক্রিয়া নিতে পারেনি।
তুরস্কের এক সরকারি কর্মকর্তা জানিয়েছেন, আসাদকে বহনকারী উড়োজাহাজের জন্য তুরস্কের আকাশসীমা ব্যবহারের কোনো অনুরোধ জানায়নি রাশিয়া। তবে বিদ্রোহীদের সঙ্গে তুরস্কের যোগাযোগের বিষয়ে কিছু জানা যায়নি।
৭ ডিসেম্বর রাত সাড়ে ১০টায় সিরিয়ার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ জালালির সঙ্গে শেষবার ফোনে কথা বলেন বাশার আল–আসাদ।
জালালি আল অ্যারাবিয়াকে জানান, তিনি আসাদকে মানুষের উদ্বাস্তু হওয়া ও আতঙ্কিত পরিস্থিতির কথা বলেন। জবাবে আসাদ বলেন, ‘আগামীকাল, আমরা বিষয়টা দেখব।’
পরদিন বিদ্রোহীরা দামেস্কে প্রবেশ করে। ৫৩ বছরের শাসনের অবসান ঘটিয়ে আসাদ মস্কোয় পালিয়ে যান।

Discussion about this post