ডেস্ক রিপোর্ট: যুক্তরাষ্ট্রের বিমান হামলায় ইরানের গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক স্থাপনায় আঘাত হানার পর রোববার পুরো বিশ্ব অপেক্ষা করছে তেহরানের প্রতিক্রিয়ার জন্য। ইসরাইলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে এটি ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের বিরুদ্ধে ১৯৭৯ সালের বিপ্লবের পর পশ্চিমা বিশ্বের সবচেয়ে বড় সামরিক অভিযান হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
সোমবার (২৩ জুন) এক প্রতিবেদনে এ খবর দিয়েছে বার্তাসংস্থা রয়টার্স।
শনিবার যুক্তরাষ্ট্র ইরানের ফোর্ডো পারমাণবিক কেন্দ্রে পর্বতের উপর বিশাল ৩০ হাজার পাউন্ড ওজনের ‘বান্কার বাস্টার’ বোমা নিক্ষেপ করে। এ ঘটনার পর ইরান আত্মরক্ষার অঙ্গীকার করে, আর আমেরিকার নেতৃত্ব তেহরানকে সতর্ক করে বলেছে—প্রতিক্রিয়া না দেখাতে। এদিকে যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভও শুরু হয়েছে।
রবিবার ‘ট্রুথ সোশ্যাল’ প্ল্যাটফর্মে দেওয়া এক পোস্টে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেন, ‘সরকার পরিবর্তন’ শব্দটা এখন রাজনৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য না হলেও, যদি বর্তমান ইরানি সরকার ‘MAKE IRAN GREAT AGAIN’ করতে না পারে, তাহলে সরকার পরিবর্তন হবে না কেন??? MIGA!!!’
এই অবস্থায় ইরান ও ইসরাইলের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ক্ষেপণাস্ত্র হামলা অব্যাহত রয়েছে। ইসরাইলি সামরিক বাহিনীর একজন মুখপাত্র জানান, ইসরাইলি যুদ্ধবিমান পশ্চিম ইরানের বেশ কয়েকটি সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালিয়েছে। এর আগে ইরান তেল আবিবে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে, যার ফলে বহু ভবন ধ্বংস হয় এবং বহু মানুষ আহত হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের স্বরাষ্ট্র নিরাপত্তা বিভাগ সতর্ক করে বলেছে, দেশজুড়ে ‘উচ্চমাত্রার নিরাপত্তা হুমকি’র আশঙ্কা রয়েছে। সাইবার হামলা বা লক্ষ্যভিত্তিক সহিংসতার শঙ্কা থেকে নিউ ইয়র্কসহ বড় শহরগুলোতে কূটনৈতিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্রগুলোতে অতিরিক্ত টহল জোরদার করা হয়েছে।
বিদেশে অবস্থানরত মার্কিন নাগরিকদের জন্য পররাষ্ট্র দপ্তর এক নিরাপত্তা সতর্কতা জারি করেছে, যেখানে বিক্ষোভ ও ভ্রমণ বিঘ্ন ঘটতে পারে বলে জানানো হয়। মধ্যপ্রাচ্যের আকাশসীমা বন্ধ থাকায় তারা যেন সতর্কতা অবলম্বন করে চলাফেরা করেন—এমন পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
এখনও পর্যন্ত ইরান সরাসরি মার্কিন ঘাঁটিতে হামলা কিংবা বিশ্বজুড়ে তেল সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়ার মতো হুমকি কার্যকর করেনি, তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যে কোনো সময় পাল্টা পদক্ষেপ নিতে পারে তেহরান।
তুরস্কের ইস্তাম্বুলে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাকচি বলেন, ‘আমরা সব ধরনের প্রতিক্রিয়া বিবেচনা করছি। প্রতিশোধ নেওয়ার আগে কোনো কূটনৈতিক আলোচনায় ফেরা হবে না।’ তিনি যুক্তরাষ্ট্রের হামলাকে আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি চরম অবজ্ঞা বলে অভিহিত করেন।
টেলিভিশনে দেওয়া এক ভাষণে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেন, ‘এই অভিযান ছিল এক অসাধারণ সামরিক সাফল্য। ইরানের প্রধান পারমাণবিক সমৃদ্ধিকরণ কেন্দ্র সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে।’বাণিজ্যিক স্যাটেলাইট চিত্রে দেখা গেছে, ফোর্দো পারমাণবিক স্থাপনার নিচে থাকা ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধির সেন্ট্রিফিউজগুলো হয় ধ্বংস হয়েছে অথবা গুরুতর ক্ষতিগ্রস্ত। যদিও এখনো এই কেন্দ্রের প্রকৃত অবস্থা নিশ্চিত করা যায়নি।
জাতিসংঘের পারমাণবিক পর্যবেক্ষণ সংস্থা আইএইএ জানিয়েছে, মার্কিন হামলার পর আশপাশের এলাকাগুলোতে রেডিওঅ্যাকটিভ বিকিরণের মাত্রা বাড়েনি। সংস্থার মহাসচিব রাফায়েল গ্রোসি সিএনএনকে জানান, ভূগর্ভস্থ ক্ষতির মাত্রা এখনো নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি।
রয়টার্সকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ইরানের এক জ্যেষ্ঠ সূত্র জানান, ফোর্ডো কেন্দ্রে থাকা অধিকাংশ উচ্চমাত্রার সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম হামলার আগেই অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। তবে রয়টার্স স্বাধীনভাবে এই তথ্য যাচাই করতে পারেনি।
ম্যাক্সার টেকনোলজিসের স্যাটেলাইট ছবিতে দেখা গেছে, বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার ফোর্দো কেন্দ্রের প্রবেশপথে শত শত গাড়ির দীর্ঘ সারি।
এদিকে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প একদিকে যুদ্ধের অবসান ঘটানোর কূটনৈতিক প্রস্তাব দিলেও, অন্যদিকে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ বৈদেশিক নীতির সিদ্ধান্তটি নিয়ে ফেলেছেন। তিনি ইরানকে সতর্ক করে বলেন, ‘এখনই শান্তি স্থাপন করতে হবে, না হলে ভবিষ্যতের হামলাগুলো আরও বড় ও সহজ হবে।’
ইরানের সর্বোচ্চ জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ পারস্য উপসাগরের হরমুজ প্রণালী বন্ধের একটি প্রস্তাব অনুমোদন করেছে। বিশ্বের প্রায় এক-চতুর্থাংশ তেল পরিবহন এই সংকীর্ণ জলপথ দিয়ে হয়, যা ইরান, ওমান ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের মাঝে অবস্থিত।
এই প্রণালী বন্ধ করে তেল সরবরাহ আটকে দিলে বিশ্ববাজারে দাম আকাশচুম্বী হয়ে উঠতে পারে, বৈশ্বিক অর্থনীতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে এবং যুক্তরাষ্ট্রের পঞ্চম নৌবহরের সঙ্গে সরাসরি সংঘাতে জড়িয়ে পড়তে পারে ইরান।
রোববার ব্রেন্ট ও মার্কিন ক্রুড অয়েলের দাম জানুয়ারির পর সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। ব্রেন্ট অয়েলের দাম বেড়েছে ৩.২০ ডলার, দাঁড়িয়েছে ৮০.২৮ ডলারে এবং ইউএস ক্রুড বেড়েছে ২.৮৯ ডলার, দাঁড়িয়েছে ৭৬.৭৩ ডলারে।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও সিবিএসকে বলেন, ‘ইরান যদি কোনো উস্কানি না দেয়, তাহলে আর কোনো সামরিক অভিযান পরিকল্পনায় নেই।’
এদিন জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ এক জরুরি বৈঠকে বসে। রাশিয়া, চীন ও পাকিস্তান মধ্যপ্রাচ্যে তাৎক্ষণিক ও নিঃশর্ত যুদ্ধবিরতির জন্য ১৫ সদস্যের নিরাপত্তা পরিষদে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করে।
জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেন, ইরানে মার্কিন বোমাবর্ষণ মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাতের এক বিপজ্জনক মোড় নেয়। তিনি যুদ্ধ বন্ধ করে কূটনৈতিক আলোচনায় ফেরার আহ্বান জানান।
যুদ্ধের লক্ষ্য ভিন্ন ভিন্ন
গত ১৩ জুন ইরানে চমকপ্রদ হামলা চালিয়ে সংঘাতের সূচনা করে ইসরাইল। দেশটি স্পষ্টভাবে জানিয়েছে, তারা ইরানের শাসক ধর্মীয় গোষ্ঠীকে ক্ষমতা থেকে সরাতে চায়।
ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেন, ইরানের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ও পারমাণবিক কর্মসূচির হুমকি নির্মূল করার লক্ষ্যে তারা প্রায় কাছাকাছি পৌঁছে গেছেন।
তবে মার্কিন কর্মকর্তারা স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন, তারা ইরানের সরকার পতনের চেষ্টা করছেন না। প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথ বলেন, ‘এই মিশন সরকার পরিবর্তন নয়, এটি একটি সুনির্দিষ্ট অপারেশন, যার লক্ষ্য ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি।’
এদিকে নিউ ইয়র্ক, ওয়াশিংটনসহ বিভিন্ন মার্কিন শহরে যুদ্ধবিরোধী কর্মীরা বিক্ষোভ করেছেন। তাদের প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল, ‘ইরান থেকে হাত সরাও।’
ইরানে অনেক নাগরিকই আশঙ্কা করছেন এই সংঘাত বড় পরিসরে গড়াতে পারে। কেন্দ্রীয় শহর কাশানের এক শিক্ষিকা ৩৬ বছর বয়সি বিতা বলেন, ‘আমাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। পালানোর কোনো পথ নেই। এটা যেন একটা ভয়াবহ সিনেমার মতো।’ এর কিছুক্ষণ পরেই ফোনলাইন বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
তেহরান শহরের বহু মানুষ শহর ছেড়ে গ্রামে চলে গেছেন ইসরাইলি বোমাবর্ষণের ভয়ে। কর্তৃপক্ষ বলছে, ইসরাইলি হামলায় এ পর্যন্ত ৪০০ জনের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন, যাদের অধিকাংশই বেসামরিক নাগরিক।
ইসরাইলের লক্ষ্যভিত্তিক হামলায় ইরানের সামরিক নেতৃত্ব মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ইরানও পাল্টা হামলা চালিয়ে গত নয় দিনে অন্তত ২৪ জন ইসরাইলিকে হত্যা করেছে।
রোববার ইসরাইলজুড়ে বোমা হামলার সতর্কতা বেজে ওঠে, লাখ লাখ মানুষ ছুটে যায় নিরাপদ কক্ষে।
তেল আবিবে ৪০ বছর বয়সি আবিয়াদ চেরনোভস্কি বলেন, ‘আশ্রয়কেন্দ্র থেকে বেরিয়ে দেখি আমার বাড়ি ধ্বংস হয়ে গেছে। এখন ইসরাইলে থাকা কঠিন, কিন্তু আমরা অনেক দৃঢ়। আমরা জানি, আমরা জয়ী হবই।’

Discussion about this post