বাংলাদেশ বুরো: সম্প্রতি বাংলাদেশে শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ব্যপক হারে বৈদেশিক আয় কমতে শুরু করেছে। এমনটি চলতে খাকলে বাংলাদেশের অর্থনীতি কোন পথে তা নিয়ে আশংকা তৈরী হয়েছে। বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের বড় দুটি উৎস রপ্তানি ও প্রবাসী আয়। দেশটিতে এই দুই খাত থেকে আয় ব্যপক হারে কমে গেছে। এই দুই খাত থেকে আয় কমলে তাতে রিজার্ভও কমে যায়।
চলতি বছরের জুন মাসের শেষে বাংলাদেশের রিজার্ভ ছিল ২১ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলার; এই পরিমাণ অর্থ তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো যেতে পারে। কিন্তু চলতি জুলাই মাসে কোটা সংস্কার আন্দোলনের জেরে সৃষ্ট সহিংসতার রাশ টানতে সরকার যে কারফিউ জারি করে ইন্টারনেট বন্ধ রেখেছিল, তার প্রভাবে রিজার্ভ কমেছে। দেশেটিতে প্রবাসী আয় আসা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে গেছে। সদ্যবিদায়ী জুলাই মাসে যে আয় এসেছে, তা গত ১০ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। জুলাই মাসে প্রবাসী আয় এসেছে প্রায় ১৯১ কোটি মার্কিন ডলার। এর আগে সবশেষ গত বছরের সেপ্টেম্বরে সর্বনিম্ন ১৩৩ কোটি ৪৩ লাখ ডলার প্রবাসী আয় এসেছিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রবাসী আয়সংক্রান্ত হালনাগাদ প্রতিবেদন থেকে এই তথ্য পাওয়া গেছে।
শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে সরকারি ও সাধারণ ছুটি মিলিয়ে গত ১৯ থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত দেশটির ব্যাংক বন্ধ ছিল। এ ছাড়া টানা ৫ দিন ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট ও ১০ দিন মোবাইলে ইন্টারনেট বন্ধ ছিল। এ কারণে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর সঙ্গে বৈদেশিক লেনদেন প্রায় বন্ধ হয়ে যায়।
জানা যায়, গত মাসের প্রথম ৩ সপ্তাহে গড়ে ৪০ থেকে ৫০ কোটি ডলার প্রবাসী আয় এসেছিল। এর মধ্যে ১ থেকে ২০ জুলাই এসেছে ১৪২ কোটি ৯৩ লাখ ডলার। আর ২১ থেকে ৩১ জুলাই আয় এসেছে ৪৭ কোটি ৯৭ লাখ ডলার। এর মধ্যে ৩১ জুলাই এক দিনেই এসেছে ১২ কোটি ডলার।
আরো জানা গেছে, গত জুনে ২৫৪ কোটি ডলার আয় দেশে পাঠিয়েছেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী প্রবাসী বাংলাদেশিরা। জুনে দেশে যে পরিমাণ প্রবাসী আয় এসেছিল, তা ছিল একক মাস হিসেবে গত তিন বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এর আগে সবশেষ ২০২০ সালের জুলাইয়ে ২৫৯ কোটি ডলারের প্রবাসী আয় এসেছিল।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, কেউ বিদেশ থেকে প্রবাসী আয় দেশে পাঠিয়ে থাকলে ব্যাংকগুলো তা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বিতরণ করতে বাধ্য। কিন্তু সংশ্লিষ্ট দেশের প্রবাসী আয় প্রেরণকারী রেমিট্যান্স হাউসগুলো যদি এ আয় ধরে রাখে, তাহলে তা দেশে আসতে কিছুটা সময় লাগে। তবে এ ক্ষেত্রে সাধারণত দুই-তিন দিনের বেশি সময় লাগে না।
এদিকে প্রবাসী আয় কমে যাওয়ায় দেশের শীর্ষস্থানীয় ১২ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে ডেকে প্রবাসী আয় বাড়াতে জোর দেওয়ার তাগিদ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকগুলো প্রবাসী আয় সংগ্রহে প্রতি ডলার ১১৭ থেকে ১১৮ টাকায় সংগ্রহ করে আসছিল। প্রবাসী আয় কমে যাওয়ার তাদের কিছুটা বাড়তি দাম দিয়ে হলেও বৈধ পথে আয় বাড়ানোর পরামর্শ দেওয়া হয়। ফলে প্রবাসী আয়ে ডলারের দাম ১২০ টাকায় উঠেছে।
দীর্ঘদিন ধরেই দেশটিতে ডলার-সংকট চলছে। এ সংকট কাটাতে এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বা মজুত বাড়াতে প্রবাসী আয়সহ বিদেশ থেকে অর্থ আনতে নানা ধরনের পদক্ষেপ নেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে আগের তুলনায় তদারকি কমিয়ে দিয়েছে। পাশাপাশি যেকোনো ধরনের অর্থ বৈধ পথে দেশে আনার ক্ষেত্রে যে নিয়মকানুন রয়েছে, তা শিথিল করেছে। গত কয়েক মাসে যার ইতিবাচক প্রভাব পড়েছিল প্রবাসী আয় দেশে আসার ক্ষেত্রে। গত মাসে সেই ধারায় কিছুটা ছন্দপতন হয়েছে।
এর আগে ২০২০ সালে করোনা মহামারির কারণে আন্তর্জাতিক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেলে দেশে বৈধ পথে প্রবাসী আয় আসা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেড়ে যায়। তখন প্রতি মাসে প্রবাসী আয়ের প্রবাহ গড়ে ২০০ কোটি ডলার ছাড়িয়েছিল। বিপুল পরিমাণ প্রবাসী আয় আসার কারণে একপর্যায়ে বৈদেশিক মুদ্রার মোট রিজার্ভ বেড়ে ৪৮ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়। তবে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর পণ্য আমদানির খরচ বেড়ে যায়। দেখা দেয় ডলার-সংকট। এ সংকট এখনো কাটেনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশে ২ হাজার ১৬১ কোটি ডলারের প্রবাসী আয় এসেছিল। আর ২০২৩-২৪ অর্থবছরে প্রবাসী আয় এসেছে ২ হাজার ৩৯১ কোটি ডলার।
বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বা রিজার্ভ এক মাসে ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন বা ১৩০ কোটি মার্কিন ডলার কমে গেছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফের হিসাবপদ্ধতি অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভের যে হিসাব করে, তাতে গত জুন শেষে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ২ হাজার ১৭৯ কোটি ডলার। জুলাই শেষে তা কমে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৪৯ কোটি ডলারে।
বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংক কয়েকটি পদ্ধতিতে রিজার্ভের হিসাব করে। তার মধ্যে একটি মোট রিজার্ভ। অন্যটি আইএমএফের হিসাবপদ্ধতি বিপিএম৬ অনুযায়ী রিজার্ভের পরিমাণ। এর বাইরে ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভেরও একটি হিসাব রয়েছে। তবে সেটি বাংলাদেশ ব্যাংক নিয়মিতভাবে প্রকাশ করে না। মোট রিজার্ভ হিসাবে থাকে দায়দেনাসহ রিজার্ভের পরিমাণ। আর বিপিএম৬ পদ্ধতিতে রিজার্ভের হিসাব হয় কিছু দায়দেনা বাদ দিয়ে। আর ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ হচ্ছে—সব দায়দেনা বাদ দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের হাতে ব্যবহার করার মতো যে রিজার্ভ থাকে সেটি।
বাংলাদেশ ব্যাংক ৩১ জুলাই যে হিসাব প্রকাশ করেছে, তাতে বিপিএম৬ অনুযায়ী রিজার্ভ কমার পাশাপাশি মোট রিজার্ভের পরিমাণও কমেছে। গত জুন শেষে মোট রিজার্ভ ছিল ২ হাজার ৬৮২ কোটি ডলার। গত জুলাই শেষে তা কমে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৫৯২ কোটি ডলারে। সেই হিসাবে মোট রিজার্ভ কমেছে ৯০ কোটি ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, সার ও খাদ্যসহ সরকারি আমদানির দায় পরিশোধে প্রতিনিয়ত রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। পাশাপাশি জুলাইয়ে প্রবাসী আয়ও জুনের তুলনায় ২৫ শতাংশ কমে গেছে।
এদিকে রিজার্ভের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, এক বছরের ব্যবধানে মোট রিজার্ভ কমেছে ৩৮১ কোটি ডলার। গত বছরের জুলাই শেষে মোট রিজার্ভ ছিল ২ হাজার ৯৭৩ কোটি ডলার। গত মাস (জুলাই) শেষে সেটি কমে ২ হাজার ৬০০ কোটি ডলারের নিচে নেমেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, আইএমএফ স্বীকৃত বিপিএম-৬ পদ্ধতি অনুযায়ী গত ১০ জুলাই রিজার্ভ ২০ বিলিয়ন বা ২ হাজার কোটি ডলারের ঘরে নেমে আসে। শিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) আমদানি বিল পরিশোধের পর ওই দিন রিজার্ভ কমে দাঁড়ায় ২ হাজার ৪৬ কোটি ডলারে। আর জুলাই শেষে সেটি ২ হাজার ৪৯ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে।

Discussion about this post