ডেস্ক রিপোর্ট: গাজায় দুই বছর ধরে চলা যুদ্ধের পর এখন সেখানে কার্যকর হয়েছে যুদ্ধবিরতি। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শান্তি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে এ যুদ্ধবিরতি বাস্তবায়িত হয়েছে। তবে বিশ্লেষকদের মতে, ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর জন্য এই শান্তি এসেছে এমন এক সময়ে, যখন তার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতা দুটোই বড় চ্যালেঞ্জের মুখে।
সমালোচকদের অভিযোগ, ক্ষমতা টিকিয়ে রাখা এবং দুর্নীতির মামলাগুলোর নজর সরাতে নেতানিয়াহু যুদ্ধকে ব্যবহার করেছেন রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে। এখন যুদ্ধবিরতি কার্যকর হলেও, তার সামনে থাকা রাজনৈতিক ও আইনি ঝুঁকিগুলো অটুট রয়েছে।
আন্তর্জাতিকভাবে ক্রমবর্ধমান বিচ্ছিন্নতা
বিশ্বজুড়ে গাজায় ৬৭ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনির মৃত্যু ও ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের চিত্র ইসরায়েলকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রায় একঘরে করে তুলেছে। অনেক পর্যবেক্ষকের মতে, নেতানিয়াহু এখন ইসরায়েলের বিচ্ছিন্নতার প্রতীক। যুক্তরাষ্ট্রের চাপে বাধ্য হয়েই তিনি যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছেন বলে মনে করেন দেশটির সাবেক রাষ্ট্রদূত অ্যালন পিঙ্কাস। তার ভাষায়, ‘এটি নেতানিয়াহুর নিজের সিদ্ধান্ত নয়, এটি সাজানো এবং ওয়াশিংটনের ইচ্ছাতেই হয়েছে।’
নেতানিয়াহু সেপ্টেম্বর মাসে ‘সুপার স্পার্টা’ নামে একটি পরিকল্পনা উপস্থাপন করেন, যা ইসরায়েলের অর্থনৈতিক ও সামরিক স্থিতি শক্ত করার লক্ষ্যে তৈরি। কিন্তু বাজারে তার বিপরীত প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়—ইসরায়েলি শেয়ারবাজার ধসে পড়ে এবং শেকেলের মান কমে যায়। দেশটির ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোও স্পষ্ট জানায়, ‘আমরা স্পার্টা নই।’
জোট রাজনীতিতে অনিশ্চয়তা
নেতানিয়াহুর সরকার টিকে আছে মূলত দেশটির চরম ডানপন্থী দলগুলোর ওপর নির্ভর করে। এই জোটের প্রধান দুটি স্তম্ভ—অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোৎরিচ এবং জাতীয় নিরাপত্তামন্ত্রী ইতামার বেন-গভির—যুদ্ধবিরতির তীব্র বিরোধিতা করছেন। তাদের মন রাখতে নেতানিয়াহু ইয়েশিভা শিক্ষার্থীদের বাধ্যতামূলক সেনাসেবা থেকে অব্যাহতি দেওয়ার নতুন আইন আনতে যাচ্ছেন, যাতে আলট্রা-অর্থোডক্স দলগুলো জোটে থাকেন এবং সরকার না ভাঙে।
যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে আইনি ঝুঁকি
আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) ইতিমধ্যেই নেতানিয়াহু, সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ত এবং হামাস কমান্ডার মোহাম্মদ দেইফের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে। দেইফ পরে ইসরায়েলি হামলায় নিহত হন। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে) ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ বিবেচনা করছে।
এই মামলাগুলোর রায় পেতে সময় লাগলেও—সম্ভবত ২০২৭ সালের আগে নয়—যদি নেতানিয়াহু দোষী সাব্যস্ত হন, তবে তার জন্য আন্তর্জাতিকভাবে বড় বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।
ট্রাম্পের সঙ্গে দূরত্ব
যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় মিত্র হলেও নেতানিয়াহুর সঙ্গে ট্রাম্পের সম্পর্ক এখন তিক্ত। ট্রাম্পের ধারণা, নেতানিয়াহু তাকে ‘ব্যবহার’ করার চেষ্টা করছেন। মে মাসে ট্রাম্প নেতানিয়াহুর সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেন, এবং সেপ্টেম্বরে হামাস কূটনীতিকদের ওপর ইসরায়েলের হামলার পর ক্ষোভ আরও বাড়ে। তিনি প্রকাশ্যে বলেন, ‘সে আমার সঙ্গে প্রতারণা করছে।’
যুদ্ধবিরতির আগে ট্রাম্প স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন, তার অনুমতি ছাড়া গাজায় সেনা মোতায়েন করা যাবে না। যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দিয়ে তিনি বলেন, ‘এই শান্তি তিন হাজার বছরের প্রস্তুতির ফল, কেউ এটিকে বিপদে ফেললে শক্ত প্রতিক্রিয়া জানানো হবে।’
তদন্ত ও দুর্নীতির মামলা
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের আকস্মিক হামলায় ইসরায়েলের নিরাপত্তা ব্যবস্থার ব্যর্থতা নিয়ে এখন একাধিক তদন্ত চলছে। এসব তদন্তে সেনা ও গোয়েন্দা প্রধানরা পদত্যাগ করেছেন। যদিও নেতানিয়াহু নিজের সরকারের ভূমিকা নিয়ে তদন্তে আপত্তি জানিয়েছেন, হাইকোর্টের রায়ে তাকে ৩০ দিনের মধ্যে জবাব দিতে হবে।
তার বিরুদ্ধে তিনটি দুর্নীতির মামলা এখনো বিচারাধীন। অভিযোগগুলোর মধ্যে ঘুষ গ্রহণ, প্রতারণা ও বিশ্বাসভঙ্গ রয়েছে। দোষী প্রমাণিত হলে সর্বোচ্চ ১০ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারে। ট্রাম্পও সম্প্রতি ইঙ্গিত দিয়েছেন, গাজার যুদ্ধ ও এই দুর্নীতির মামলাগুলোর মধ্যে ‘রাজনৈতিক সংযোগ’ রয়েছে।
সব মিলিয়ে, যুদ্ধবিরতির পর নেতানিয়াহুর সামনে এক অনিশ্চিত রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ—যেখানে আন্তর্জাতিক চাপ, আইনি ঝুঁকি ও অভ্যন্তরীণ বিভাজন মিলেমিশে তার নেতৃত্বকে কঠিন পরীক্ষার মুখে ফেলেছে।