ডেস্ক রিপোর্ট: মার্কিন রাজনীতির বহু আলোচিত চরিত্র প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আবারও বিশ্বমঞ্চে নিজস্ব কৌশলগত কাণ্ডজ্ঞান নিয়ে ফিরে এসেছেন। তবে তার এবারের প্রত্যাবর্তন আরেকটু ভিন্ন, আরেকটু ধূসর। সম্প্রতি মধ্যপ্রাচ্য সফরে তিনি সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও কাতারে গেলেও ইসরাইল সফর করেননি। ইসরাইলকে ট্রাম্পের এই উপেক্ষা নিছক কূটনৈতিক অনুচ্চার নয়, বরং এক গভীর রাজনৈতিক সঙ্কেত।
ট্রাম্প তার আগের আমলে যেভাবে ইসরাইল-ঘেঁষা পররাষ্ট্রনীতি চালিয়ে গিয়েছিলেন— জেরুজালেমে দূতাবাস স্থানান্তর, গোলান মালভূমিকে ‘ইসরাইলি এলাকা’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া—এ সবই ট্রাম্পের এবারের প্রসাশনের সঙ্গে বিস্তর ফারাক তৈরি করছে।
ট্রাম্পের সাম্প্রতিক মধ্যপ্রাচ্য সফরে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও কাতারের সরব উপস্থিতি থাকলেও তালিকা থেকে বাদ পড়ে গেছে দখলদার ইসরাইল। আর এটি এমনই এক বহুল আলোচিত পদক্ষেপ ছিল, যা বেশ কিছু রাষ্ট্রীয় উদ্বেগ ও বিশ্লেষণের জন্ম দিয়েছে।
অবহেলা নাকি কৌশলগত দূরত্ব?
ট্রাম্প অবশ্য বলেছেন, এটি কোনো অপমান নয়। বরং তার ভাষ্য অনুযায়ী, এই সফর ‘ইসরাইলের জন্য ভালো’। কারণ তিনি আরব দেশগুলোর সঙ্গে নতুন স্বাভাবিকীকরণ চুক্তি ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছেন।
তবে ওয়াশিংটন ভিত্তিক সংবাদমাধ্যম দ্য আটলান্টিক জানায়, ট্রাম্পের এই সফর ও নীতিগত পরিবর্তনগুলো ইসরাইল-কে কেন্দ্র থেকে সরিয়ে আনার একটি ইঙ্গিত। আর এটি তেলআবিবে দারুণ অস্বস্তি সৃষ্টি করেছে।
ইরানকে কেন্দ্র করে উত্তেজনা
এদিকে ট্রাম্প প্রশাসন আবারও ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে পরোক্ষ আলোচনা শুরু করেছে। দুই দেশের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের মধ্যে ইতোমধ্যেই চতুর্থ দফার আলোচনার শেষ হয়েছে। তবে এই আলোচনা বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সরকারের জন্য একটি রাজনৈতিক দুঃস্বপ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে।
তেলআবিব বহুদিন ধরেই ইরানকে একটি ‘অস্তিত্ববাদী হুমকি’ হিসেবে চিত্রিত করে এসেছে। সেই পরিস্থিতিতে ওয়াশিংটনের এমন এক নমনীয় কূটনীতির রূপ ইসরাইলকে নিরাপত্তাহীনতায় ফেলে দিয়েছে।
সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হচ্ছে- ট্রাম্প প্রশাসনের ইরানের সঙ্গে পরোক্ষভাবে পারমাণবিক আলোচনায় ফিরে যাওয়া। ইসরাইল এই ইস্যুকে অস্তিত্বের হুমকি হিসেবে দেখে। ইরানের ওপর নিষেধাজ্ঞা শিথিলের সম্ভাবনাই মূলত নেতানিয়াহু সরকারের জন্য আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
গাজা যুদ্ধ নিয়েও ‘উদ্বিগ্ন’ ইসরাইল
গাজায় চলমান ইসরাইলি হামলার মাঝেই ট্রাম্প সরাসরি যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছেন। আর এটি এমন এক সময়ে এলো যখন তেলআবিব ‘চূড়ান্ত সামরিক জবাব’-এর কৌশল নিচ্ছে। ট্রাম্প আগের প্রশাসন হলে হয়তো এমন ঘটনার মুখোমুখি হতেন না নেতানিয়াহু। তবে এখন পরিস্থিতি ভিন্ন।
ট্রাম্পের সরাসরি যুদ্ধবিরতির আহ্বানই মূলত ইসরাইলি নিরাপত্তা বৃত্তে মার্কিন সমর্থন দুর্বল হয়ে যাচ্ছে—এমন উদ্বেগ জোরদার করে।
নেতানিয়াহুকে উপেক্ষা করে বন্দি উদ্ধার
এছাড়াও সম্প্রতি ট্রাম্প প্রশাসন তেলআবিবের কোনোরকম অংশগ্রহণ ছাড়াই ইসরাইলি-মার্কিন নাগরিক এডান আলেক্সান্ডারকে হামাসের বন্দিশালা থেকে মুক্ত করেছে। এই পদক্ষেপটিও নেতানিয়াহুর কূটনৈতিক ব্যর্থতা এবং ওয়াশিংটনের কৌশলগত দূরত্বের প্রতীক হয়ে উঠেছে।
সিরিয়ার নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার: ইসরাইলকে চ্যালেঞ্জ
আরেকটি বড় ঘটনা হলো- ট্রাম্পের সৌদি সফরে সিরিয়ার নতুন রাষ্ট্রপ্রধান আহমাদ আল-শারার সঙ্গে বৈঠক। যা গত দুই দশকের মধ্যে প্রথম ঘটনা যে, কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্ট সিরিয়ার নেতার সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন। ঐতিহাসিক এই সাক্ষাতের পরই সিরিয়ার ওপর থেকে সব নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন ট্রাম্প। একই সঙ্গে তিনি আল-শারাকে ‘অসাধারণ নেতা’ বলে অভিহিত করেন।
মূলত এখানেও ব্যাকফুটে চলে গেছে ইসরাইল। কারণ, ইসরাইল দীর্ঘদিন ধরে সিরিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি রাখার পক্ষে ছিল। তারা সেখানে নিজস্ব সামরিক অভিযান ও দ্রুজ গোষ্ঠীর প্রতি সমর্থন অব্যাহত রেখেছে। যে কারণে ট্রাম্পের এই পদক্ষেপটি ইসরাইলের কৌশলগত অবস্থানকে চ্যালেঞ্জ করেছে।
ট্রাম্পের সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আহমাদ আল-শারার সঙ্গে সাক্ষাৎ ও নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার কেবল মধ্যপ্রাচ্যে একটি নয়া সমীকরণই তৈরি করেনি বরং ইসরাইলের পুরনো কৌশলগত লাইনগুলোও ভেঙে দিয়েছে। তেলআবিব বরাবরই চেয়েছে সিরিয়াকে আন্তর্জাতিকভাবে বিচ্ছিন্ন রাখতে। এখন ট্রাম্পের পদক্ষেপ তাদের সেই নীতিকে জোরালোভাবে চ্যালেঞ্জ করছে।
ইয়েমেন যুদ্ধেও মার্কিন অবস্থানের পরিবর্তন
এদিকে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের পর হুথি নিয়ন্ত্রিত ইয়েমেনের সামরিক বাহিনী ইসরাইলের ভূখণ্ড ও বিমানবন্দরে ক্রমাগত ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়ে আসছে। সেই সঙ্গে লোহিত সাগরে অবস্থান নেওয়া মার্কিন যুদ্ধজাহাজেও হামলা চালায়। প্রথম দিকে অবশ্য যুক্তরাষ্ট্র পাল্টা সামরিক পদক্ষেপ নেয় এবং ইসরাইল তাতে প্রশংসা করে।
কিন্তু তারপরেই ট্রাম্প প্রশাসন ইয়েমেনের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি চুক্তি করে। যার পুরোটা হয় ইসরাইল-কে উপেক্ষা করে। এই চুক্তি ঘোষণার ঠিক দুই দিন আগে ইয়েমেনের একটি হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র তেলআবিবের বেন-গুরিয়ন বিমানবন্দরে আঘাত হানে। যার ফলে সেখানে প্রায় ৩০ ফুটের মতো গর্ত সৃষ্টি হয় এবং ৬ জন আহত হয়। এরপরও তেলআবিবকে সম্পূর্ণ দূরে রেখেই যুক্তরাষ্ট্র-ইয়েমেন আলোচনার পরিসমাপ্তি ঘটে।
হুথিদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধবিরতি আলোচনায় ইসরাইলের অনুপস্থিতি এক প্রকার কূটনৈতিকভাবে বাদ পড়া। ওয়াশিংটনের মধ্যস্থতায় এই চুক্তি হলেও তেলআবিব যেন কেবল একটি দর্শকের ভূমিকায় অবস্থান করছিল।
মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সীমিত প্রভাব: ইসরাইল যেন বড় একা!
দ্য আটলান্টিক বলছে, ট্রাম্পনীতির এই পরিবর্তনগুলো একটি নতুন মার্কিন কৌশলগত বাস্তবতার ইঙ্গিত দেয়—যেখানে যুক্তরাষ্ট্র আর আগের মতো জোরালো ভূমিকায় থাকতে চায় না।
বাইডেন প্রশাসন যেখানে গাজায় হামলা চলাকালীন ইসরাইলকে পূর্ণ সামরিক সহায়তা দিয়ে গিয়েছিল, সেখানে ট্রাম্পের নতুন মন্ত্রিসভা অনেক বেশি বিদেশে জড়িত থাকা নিয়ে সতর্ক ও সীমিতমুখী।
এই যেমন- সিরিয়ায় মার্কিন সেনা সংখ্যা কমানো এবং ট্রাম্প প্রশাসনের বর্তমান পলিসি জোটকে পুনর্গঠন করা এবং এককভাবে যুদ্ধবাজ নীতি থেকে সরে আসা।
এ সবকিছুই একটি স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয় যে, যুক্তরাষ্ট্র এখন আর আগের মতো মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইলের জন্য ‘নিরাপত্তার ছাতা’ হতে চায় না। বরং তারা এখন কৌশলগত ভারসাম্য পুনর্বিবেচনা করছে। যেখানে ইসরাইল কেবল একমাত্র সুবিধাভোগী নয়, বরং ইরান সমর্থিত দেশ ও গোষ্ঠীগুলোর সমন্বয়ে একটি স্বনির্ভর আঞ্চলিক শক্তি দানা বাধতে বাধ্য হচ্ছে।
নতুন বাস্তবতায় পুরনো নীতি কি ভেঙে পড়ছে?
মূলত ইসরাইলের জন্য এটি এক নীতিগত ঝাঁকুনি। ট্রাম্প যতই বলুন যে, এই পরিবর্তন ইসরাইলের জন্য ভালো। তবে বাস্তবতা হলো- তেলআবিব এখন সেই ছায়া থেকে বেরিয়ে এসেছে, যা তাকে এতদিন নিরাপত্তা দিয়েছিল। পররাষ্ট্রনীতিতে যখন মিত্ররা নিজ নিজ হিসেব কষে আগায়, তখন পুরনো বন্ধনগুলো ঝুঁকিতে পড়ে।
এ মুহূর্তে প্রশ্ন শুধু একটাই—মধ্যপ্রাচ্যের নতুন বাস্তবতায় ইসরাইল কতটা একা হয়ে পড়বে এবং তারা কি প্রস্তুত এই নতুন একাকীত্বের মুখোমুখি হতে?
যদিও ইসরাইল তার পুরনো মিত্রকে হারাচ্ছে না। তবে হয়তো তাকে ‘একঘরে’ হতে হবে এক নতুন রূপান্তরিত মধ্যপ্রাচ্যে।
খবর : দ্য আটলান্টিক ও আল-মায়াদিন

Discussion about this post