ডেস্ক রিপোর্ট: গাজার দক্ষিণাঞ্চলে এক ত্রাণ বিতরণকেন্দ্রে কিছু খাবার পেয়ে সাবেক মার্কিন সেনা কর্মকর্তা অ্যান্থনি আগুইলারকে ধন্যবাদ জানিয়েছিল শিশু আমির। চোখে মুখে কৃতজ্ঞতার হাসি। কিন্তু কয়েক মিনিট পরই ইসরায়েলি বাহিনীর গুলিতে তার প্রাণ চলে যায়। এই মর্মস্পর্শী ঘটনাটি বর্ণনা করেছেন আগুইলার নিজেই, যিনি যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ সামরিক শাখার সাবেক সদস্য। তিনি সম্প্রতি ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত বিতর্কিত ত্রাণ সংস্থা ‘গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন’ (জিএইচএফ) থেকে পদত্যাগ করেছেন।
সোমবার (২৮ জুলাই) আনএক্সেপ্টেবল নামের একটি পডকাস্টে আগুইলার জানান, ২৮ মে তিনি দক্ষিণ গাজার জিএইচএফ পরিচালিত এক ত্রাণ বিতরণকেন্দ্রে কর্মরত ছিলেন। সেখানে তিনি নিজ চোখে দেখেছেন কীভাবে শিশু আমিরসহ অসংখ্য নিরস্ত্র ফিলিস্তিনি ইসরায়েলি বাহিনীর হামলার শিকার হয়েছেন।
আগুইলার বলেন, ‘আমির ছেঁড়া জামা পরে, খালি পায়ে আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল। ক্ষুধায় কঙ্কালসার দেহে তার কাপড় ঝুলে পড়ছিল। সে ১২ কিলোমিটার হেঁটে এসেছিল শুধু সামান্য খাবারের আশায়।’ তিনি জানান, শিশুটি খাবার পেয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে গালে হাত বুলিয়ে চুমু দেয় এবং ইংরেজিতে বলে, ‘থ্যাংক ইউ।’
তবে সেই মানবিক দৃশ্যের অবসান ঘটে মুহূর্তেই। কিছু সময় পরেই ইসরায়েলি বাহিনী ত্রাণ নেওয়া মানুষদের লক্ষ্য করে মরিচের গুঁড়ার স্প্রে, কাঁদানে গ্যাস এবং স্টান গ্রেনেড ছোড়ে। শুরু হয় নির্বিচার গুলিবর্ষণ। আগুইলারের বর্ণনায়, আমির তখন ভয় পেয়ে দৌড় দেয়, এবং সেখানেই ইসরায়েলি গুলিতে প্রাণ হারায় শিশুটি।
জাতিসংঘের তথ্যমতে, মে মাসের শেষ দিকে কার্যক্রম শুরু করার পর থেকে জিএইচএফ পরিচালিত বিতরণকেন্দ্র থেকে খাবার নিতে গিয়ে ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে নিহত হয়েছেন এক হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি।
গাজার বাসিন্দা বাস্তুচ্যুত যুবক ইউসুফ আল-আজউরি মিডল ইস্ট আই কে বলেন, খাবারের জন্য জীবন বাজি রেখে ছুটে যাওয়ার অভিজ্ঞতা যেন ‘স্কুইড গেম’ সিরিজের মতো, যেখানে বেঁচে থাকার লড়াই হয়ে ওঠে রক্তাক্ত খেলা।
ইসরায়েলি বাহিনীর সদস্যরাও স্বীকার করেছেন, তাদেরকে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে গাজায় ত্রাণের অপেক্ষায় থাকা নিরস্ত্র মানুষদের লক্ষ্য করে গুলি চালানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
জাতিসংঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনআরডব্লিউএর কমিশনার-জেনারেল ফিলিপ লাজারিনি এই অবরোধ ও মানবিক বিপর্যয়কে ‘মানবসৃষ্ট এবং পরিকল্পিত দুর্ভিক্ষ’ বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, ‘জিএইচএফের ত্রাণ বিতরণব্যবস্থা ত্রুটিপূর্ণ। এটি মানবিক সংকট মোকাবেলার জন্য তৈরি হয়নি। বরং এটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে।’
ইসরায়েল ২০২৫ সালের ২ মার্চ থেকে গাজা উপত্যকায় সম্পূর্ণভাবে খাদ্য ও মানবিক সহায়তা প্রবেশের পথ বন্ধ করে দেয়। ফলস্বরূপ, লাখো মানুষ চরম খাদ্যসংকটে পড়ে। জাতিসংঘ-সমর্থিত ইন্টিগ্রেটেড ফুড সিকিউরিটি ফেজ ক্লাসিফিকেশন (আইপিসি)-এর সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গাজার প্রায় সব এলাকাতেই পরিস্থিতি এখন ‘দুর্ভিক্ষের মাত্রা’ ছুঁয়েছে। গড়ে প্রতি তিন শিশুর মধ্যে একজন মারাত্মক অপুষ্টিতে ভুগছে।
অ্যান্থনি আগুইলার বলেন, ‘আমি মার্কিন জনগণ ও ইসরায়েলিদের বলছি—আমি গাজায় ছিলাম, ওদের ছুঁয়ে দেখেছি, কথা বলেছি। ওরা পশু নয়, মানুষ। অথচ তাদের সঙ্গে পশুর মতো আচরণ করা হচ্ছে। এমনকি আমরা আত্মসমর্পণ করা আইএস যোদ্ধাদের চেয়েও গাজার সাধারণ মানুষদের কম সম্মান দিচ্ছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘এই মানবিক বিপর্যয় কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়, এটা ইচ্ছাকৃতভাবে তৈরি করা হয়েছে। মানুষকে পরিকল্পিতভাবে অনাহারে রাখা হচ্ছে।’
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া ইসরায়েলি অভিযানে এখন পর্যন্ত ৬০ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। এই গণহত্যার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নীরবতা নিয়েও ক্ষোভ বাড়ছে। গত সপ্তাহেই বিশ্বের ১০০টির বেশি মানবাধিকার ও ত্রাণ সংস্থা ইসরায়েলের অবরোধ তুলে নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।
ইউএনআরডব্লিউএর তথ্য অনুযায়ী, দুর্ভিক্ষ ও অপুষ্টিতে তাদের অনেক কর্মীও সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ছেন। ইতিমধ্যেই গাজায় অনাহারে প্রাণ হারিয়েছেন প্রায় ১৫০ শিশু ও প্রাপ্তবয়স্ক।