Print Date & Time : 19 April 2025 Saturday 10:34 am

অবৈধ সম্পত্তির পাহাড় গড়েও ধরা ছোঁয়ার বাইরে বেনজির !

বাংলাদেশ বুরো: বাংলাদেশের সাবেক পুলিশ প্রধান বেনজীর আহমেদ ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় ক্ষমতার অপব্যবহার করে অবৈধভাবে বিপুল সম্পত্তির পাহাড় গড়েছেন। গণমাধ্যমে এসব সম্পত্তির তথ্য সামনে আসার পর দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তদন্তে নামে। অনুসন্ধানে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ ও তাঁর পরিবারের বিপুল সম্পদের তথ্য বেরিয়ে আসার পর থেকে তাঁকে নিয়ে দেশজুড়ে আলোচনা চলছে। দুর্নীতির জন্য তাঁকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর দাবি ওঠে বিভিন্ন মহল থেকে। বেনজীর আহমেদ এখন কোথায় আছেন, সে বিষয়ে নিশ্চিতভাবে কারও কাছ থেকে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র নিশ্চিত করেছে, বেনজীর আহমেদ দেশে নেই। বিভিন্ন মহলে আলোচনা আছে বেনজীর আহমেদ এখন সিঙ্গাপুরে আছেন। তবে তিনি আসলেই সিঙ্গাপুর আছেন নাকি অন্য কোনো দেশে আছেন, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

এদিকে বেনজীর আহমেদের দেশত্যাগ বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘তাঁকে আমরা এখনো নিষেধাজ্ঞা দিইনি। সে যদি নিষেধাজ্ঞার আগে চলে গিয়ে থাকে…৷ আমি এখনো কিন্তু সঠিক জানি না, সে আছে নাকি চলে গেছে। আমাকে জেনে কথা বলতে হবে। তিনি আছেন কি না, না আছেন, সেটা আমি এখনো সুনিশ্চিত নই। আমার পুলিশ বাহিনী অনেক ভালো কাজ করছে, অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে। কোনো ব্যক্তি যদি কিছু করে থাকে, তার দায় প্রতিষ্ঠান নেয় না।’

বেনজীর আহমেদ ২০২০ সালের ১৫ এপ্রিল থেকে ২০২২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আইজিপি ছিলেন। এর আগে তিনি ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার ও র‍্যাবের মহাপরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে র‍্যাব এবং র‍্যাবের সাবেক ও বর্তমান যে সাত কর্মকর্তার ওপর যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা দেয়, তাঁদের মধ্যে বেনজীর আহমেদের নামও ছিল। তখন তিনি আইজিপির দায়িত্বে ছিলেন।

দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) বলছে, বেনজীর আহমেদ ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে বিপুল জমি ও কোম্পানির শেয়ারের মালিকানা অর্জন করেছেন। বেনজীর আহমেদ ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নামে থাকা জমি জব্দ (ক্রোক) এবং বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকে তাঁদের নামে থাকা ব্যাংক হিসাব (অ্যাকাউন্ট) অবরুদ্ধ (ফ্রিজ) করার আদেশ দেন আদালত। শেয়ারবাজারে থাকা বিও (বেনিফিশিয়ারি ওনার্স) হিসাব অবরুদ্ধ করারও নির্দেশ দেওয়া হয়।

দুই দফা মিলিয়ে আদালত বেনজীর আহমেদ ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের ৬২১ বিঘা জমি জব্দের আদেশ দিয়েছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি জমির মালিক বেনজীরের স্ত্রী জীশান মীর্জা। তাঁর নামে প্রায় ৫২১ বিঘা জমি খুঁজে পেয়েছে দুদক। বাকি ১০০ বিঘার মতো জমি রয়েছে বেনজীর, তাঁর তিন মেয়ে ফারহিন রিশতা বিনতে বেনজীর, তাহসিন রাইশা বিনতে বেনজীর ও জারা জেরিন বিনতে বেনজীর এবং স্বজন আবু সাঈদ মো. খালেদের নামে। পুলিশের সাবেক এ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নামে গোপালগঞ্জ ও মাদারীপুরে যে ৬০০ বিঘা জমি কেনা হয়েছে। এসব জমির প্রায় সবই ছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের। তাঁরা বলছেন, জমি বিক্রি ছাড়া তাঁদের কোনো উপায় ছিল না। ভয় দেখিয়ে, জোর করে এবং নানা কৌশলে তাঁদের কাছ থেকে জমিগুলো কেনা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এই জমির উপরই নির্মিত হয়েছে সাভানা ইকোরিসোর্ট অ্যান্ড ন্যাচারাল পার্ক ।

সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদের পরিবারের মালিকানাধীন সাভানা ইকোরিসোর্ট অ্যান্ড ন্যাচারাল পার্ক :

এদিকে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ এবং তাঁর স্ত্রী ও তিন মেয়েকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য গত ২৮ মে মঙ্গলবার তলব করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দুদকের প্রধান কার্যালয় থেকে পাঠানো নোটিশে বেনজীর আহমেদকে আগামী ৬ জুন এবং তাঁর স্ত্রী ও সন্তানদের ৯ জুন দুদকে হাজির হয়ে বক্তব্য দিতে বলা হয়েছে।

অপরদিকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, সাবেক পুলিশ প্রধান বেনজীর আহমেদ বিদেশে থাকলেও তার বিচার চলবে । তিনি বলেন, বেনজীর আহমেদ দোষী সাব্যস্ত হলে তাঁকে দেশে ফিরতেই হবে। সরকার কোনো ছাড় দেবে না।

বেনজীর আহমেদ ও তাঁর পরিবারের বিপুল সম্পত্তি অর্জনের বিষয়ে সম্প্রতি দুই পর্বে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন (সাবেক আইজিপির অপকর্ম-১ ও ২) প্রকাশ করে কালের কণ্ঠ। গত ৩১ মার্চ প্রকাশিত প্রথম পর্বের মূল শিরোনাম ছিল ‘বেনজীরের ঘরে আলাদীনের চেরাগ’। প্রতিবেদনে বলা হয়, বেনজীরের পরিবারের মালিকানায় রয়েছে প্রায় ১ হাজার ৪০০ বিঘা জমির ওপর নির্মিত ইকো রিসোর্ট। এই রিসোর্টের পাশে আরও ৮০০ বিঘা জমি কিনেছে তাঁর পরিবার। এ ছাড়া পাঁচ তারকা হোটেলের ২ লাখ শেয়ারও রয়েছে তাঁদের। ঢাকার বসুন্ধরায় সাড়ে তিন হাজার বর্গফুটের ফ্ল্যাটও রয়েছে বেনজীরের পরিবারের। এসব সম্পত্তি অবৈধ টাকায় কেনা হয় বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

‘সাবেক আইজিপির অপকর্ম-২’ প্রকাশ করা হয় ২ এপ্রিল। এই পর্বের মূল শিরোনাম ছিল ‘বনের জমিতে বেনজীরের রিসোর্ট’। এই প্রতিবেদনে বলা হয়, গাজীপুর সদরের ভাওয়াল গড় ইউনিয়নের নলজানী গ্রামে ১৬০ বিঘা জমির ওপর ভাওয়াল রিসোর্ট গড়ে তোলা হয়েছে। এই রিসোর্ট করতে বনের ২০ বিঘা জমি দখল করা হয়েছে। এই রিসোর্টের ২৫ শতাংশের মালিকানা বেনজীর আহমেদের পরিবারের। এ ছাড়া দুবাইয়ে শতকোটি টাকার হোটেল ব্যবসা, সিঙ্গাপুরে সোনার ব্যবসা এবং থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায় তাঁর পরিবারের জমি রয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

কালের কণ্ঠ-এর প্রতিবেদনের পর ২০ এপ্রিল নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে একটি ভিডিও প্রকাশ করেন বেনজীর আহমেদ। ভিডিওতে তিনি দাবি করেন, তাঁর পরিবারের যে সম্পদ রয়েছে, তা বৈধ এবং এর হিসাব ট্যাক্স ফাইলে উল্লেখ রয়েছে। অবৈধ যেসব সম্পত্তির কথা বলা হচ্ছে, তা কেউ প্রমাণ করতে পারলে ওই ব্যক্তি বা গ্রুপকে সেই সম্পত্তি তিনি বিনা পয়সায় লিখে দেবেন বলেও ভিডিওতে দাবি করেন।

তবে বেনজীর ও তাঁর স্ত্রী-সন্তানদের সম্পদ জব্দে দুদকের আবেদন এবং আদালতের আদেশ নিয়ে এখনো কোনো প্রতিক্রিয়া জানাননি তিনি। এই ঘটনার পর থেকে অনেকটা লাপাত্তা পুলিশের সাবেক এই শীর্ষ কর্মকর্তা।